শ্রমের মর্যাদা রচনা. Helped school.
শ্রমের মর্যাদা রচনা
আরও পড়ুন ঃ
ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পুর্ন রচনা
প্রবন্ধ-সংকেত ঃ
[ ১.ভূমিকা ॥
২.শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা ॥
৩.শ্রমের প্রকারভেদ ৷।
৪.ভাগ্যরচনা ও প্রতিভা বিকাশে শ্রম ॥
৫.শ্রমিক লাঞ্ছনা ॥
৬.সকল ধর্মে শ্রমের মর্যাদা ॥
৭.শ্রমের জয় ॥
৮.বাংলাদেশে শ্রমের স্থান ॥
৯.শ্রমের সুফল ॥
১০.উপসংহার ।। ]
“বিশ্বপিতার মহা-কারবার এই দিন দুনিয়াটা ।
মানুষই তাহার মহামূল্যবান, কর্ম তাহার খাটা।"
—যতীন্দ্রমােহন বাগচী।
ভূমিকা :
এই বিশাল পৃথিবী বিশ্ববিধাতার মহাকারখানা। এখানে সকলকে সাধ্যমত পরিশ্রম করতে হয়, শ্রম দিতে হয় । সবাইকে যে যার ক্ষমতা অনুসারে সাজাতে হয় পরিশ্রমের অনবদ্য উপাচার। তাতেই সভ্যতার সৌধ হয়ে ওঠে অপরূপ। সভ্যতার এ চরম বিকাশের মূলে আছে যুগযুগান্তরের লক্ষ-কোটি মানুষের অফুরন্ত শ্রম। বহু মানুষ তাদের বহুদিনের শ্রম দান করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এই অনবদ্য তিলােত্তমা মূর্তি। তারা পাহাড় কেটে পথ প্রস্তুত করেছে, সেতু বন্ধনে বেঁধেছে নদীর উভয় তটভূমিকে, নির্মাণ করেছে প্রাসাদ অট্টালিকা। কেউ ফলিয়েছে সােনার ধান, কেউ বুনেছে লজ্জা নিবারণের বস্ত্র, কেউ বা জীবনকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তােলার জন্য রচনা করেছে সৌন্দর্যমণ্ডিত, শিল্প সৌকর্যময় নানা দ্রব্যসামগ্রী। সকলের পরিশ্রম বা শ্রমের যৌথ প্রয়াসে সম্ভব হয়েছে সভ্যতার এ অনবদ্য বিকাশ । সভ্যতা মানুষের শ্রমেরই সম্মিলিত যােগফল।
শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা :
মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। ছােট হােক বড় হােক সকলেরই কাজের প্রয়ােজন আছে এবং যার যার দায়িত্ব যথাযথ পালনের মধ্যে জীবনের সুখকর অস্তিত্ব নির্ভরশীল। জীবনের উন্নতির চাবিকাঠি পরিশ্রমের মধ্যে বিদ্যমান। শ্রমের এহ অপিরসীম গুরুত্ব বিবেচনায় শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে। আজকের বিশ্বের বিপুল অগ্রগতির পেছনে যেমন শ্রমজীবী মানুষের অবদান রয়েছে, তেমনি শ্রমজীবী সমাজের অসহযােগিতা জীবনকে বিষময় করে তুলবে । বিশ্বের উন্নত দেশগুলাের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, শ্রমের প্রাত তারা মর্যাদাশীল বলে তাদের উন্নতি এত ব্যাপক হয়েছে। সেসব দেশে ছােট বড় বলে কোনাে পার্থক্য নেই। কাজ যাই হােক না কেন তাতে কোনাে অমর্যাদা লুকিয়ে থাকে না। কায়িক বা দৈহিক পরিশ্রম সেসব দেশে কখনাে কোনাে অগৌরব নিয়ে আসে না। তাই সকলেই সব রকম কাজের প্রতি সমান আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। জীবনের সাথে শ্রমের একটা নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। মানবজীবনে শ্রমের এই বিশেষ গুরুত্ব দেখাতে গিয়ে কবি বলেছেন—
“চাষী ক্ষেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বােনে, জেলে ফেলে জাল,
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার,
তারি’ পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।”
শ্রমের প্রকারভেদ :
শ্ৰম প্রধানত দু প্রকার– দৈহিক বা কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্ৰম । মানবসমাজে দু ধরনের শ্রমেরই মূল্য আছে। যারা দেহ আচয়ে পরিশ্রম করে, তাদের শ্রমকে দৈহিক বা কায়িক শ্রম বলে। আর যে শ্রমে বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগানাে হয়, তাকে বলে মানসক এম। জীবন পথে চলতে গেলে উভয় প্রকার শ্রমেরই প্রয়ােজন রয়েছে।
ভাগ্যরচনা ও প্রতিভা বিকাশে শ্ৰম :
মানুষ একদিকে যেমন সভ্যতার স্রষ্টা, অন্যদিকে তেমনি নিজের ভাগ্যেরও নির্মাতা। নিজের ভাগ্যকে মানুষ নিজেই নিমাণ করতে পারে। তার ভাগ্য নির্মাণের হাতিয়ার হলাে তার পরিশ্রম। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে সুপ্ত প্রতিভা । পৃথিবীতে যে সকল ব্যক্তি প্রতিভাবান বলে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তাঁরা আজীবন করেছেন কঠোর পরিশ্রম এবং তার ফলে তাঁদের প্রতিভা ফুলের মতাে বিকশিত হয়ে পৃথিবীকে বিতরণ করেছে অনাবিল সৌরভ। পরিশ্রমই মানুষের প্রতিভা বিকাশ ও ভাগ্য গঠনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। শ্রমের এই গুরুত্ব বিবেচনা করেই পাশ্চাত্য মনীষী virgil বলেছেন, "The dignity of labour makes a man self-confident and high ambitious So, the evaluation of labour is essential."
শ্রমিক লাঞ্ছনা :
সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ যারা, তারা গ্রহণ করেছে সমাজের সম্মানের কাজ, গৌরবের কাজ। সমাজের সমস্ত সুখ-সুবিধা নিজেরা কুক্ষিগত করে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মানুষদের নিক্ষেপ করেছে ঘৃণা ও বঞনার নীর অন্ধকারে । অথচ সেই শ্রমিকেরা চিরকাল মাঠে মাঠে বীজ বুনেছে, ফলিয়েছে সােনার ফসল, তাঁতি বসে তাঁত বুনেছে, জেলে ধরেছে মাছ। অথচ স্বার্থপর সমাজের কাছ থেকে তারাই পায় নি মানুষের মর্যাদা।
সকল ধর্মে শ্রমের মর্যাদা :
সকল ধর্মেই শ্রমের মর্যাদাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে শ্রমের ও শ্রমিকের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে ও শ্রমিকদের ঘাম শুকানাের আগেই তার পারিশ্রমিক দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে কর্মবাদের কথা অর্থাৎ পরিশ্রমের মাধ্যমে সৎ উপার্জনের কথা বলা হয়েছে । খ্রিষ্টধর্মে শ্রমহীন বেকার মানুষের মর্যাদা নেই । অন্যান্য ধর্মেও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের অবস্থার পরিবর্তন অর্থাৎ উন্নতি করার কথা বলা হয়েছে। শ্রমের প্রকারভেদ বড় কথা নয় । যে কোনাে শ্রমেরই গুরুত্ব ও মর্যাদা সমান।
শ্রমের জয় :
শ্রমিক সমাজ আজ বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানবিক শ্রমকে তার যােগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কালের যাত্রায় একমাত্র তারাই আজ সমাজের রথকে গতি দিতে পারে, একমাত্র তারাই পারে সমাজে কর্মমুখরতার ঢেউ আনতে । তাই আজ শ্রমের জয় বিঘােষিত হচ্ছে দিকে দিকে । শ্রমিক দুনিয়ার প্রতি সকলের দৃষ্টি আজ আকৃষ্ট হয়েছে। দেশে দেশে আজ শ্রমিক সংঘ এবং শ্রমিক কল্যাণ স্বীকৃতি লাভ করেছে। সমাজ কাব্যে। উপেক্ষিত এই শ্রমকে তার যােগ্য সম্মান না দিলে যে সমাজের উত্থান নেই, অগ্রগতি নেই—এ কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশে শ্রমের স্থান :
বাংলাদেশে শ্রমবিভাগ ছিল প্রধানত বর্ণগত। যারা উঁচু বর্ণের তারা কোন কাজ করত না। নিচু বণের লােকেরা পাহক। বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ করত। তাতে সমাজে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, যারা শারীরিক পরিশ্রম করে তারা সমাজে সম্মানের পাত্র নয়। এভাবে কায়িক পরিশ্রম আমাদের দেশে অবজ্ঞা পায় এবং আমরা কর্মবিমুখ হয়ে পড়ি। এটাই আমাদের অবনতির মূল কারণ।
শ্রমের সুফল :
পরিশ্রম ছাড়া সমাজের কোনাে কাজই সম্পাদিত হতে পারে না । সমস্ত কাজই পৃথিবীর কাজ। পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি পারমা, সে জাতি ও দেশ তত উন্নত। পৃথিবীর মানুষ হিসেবে সকল কাজই মানুষের করণীয়। তাতে যেমন কাজের কোনাে জাতিভেদ নেই, যারা সেই কাজ। করে তাদেরও কোনাে জাতিভেদ নেই। সুতরাং পরিশ্রম করা মােটেই সম্মান হানিকর নয়। এতে ব্যক্তির আত্মােন্নয়ন যেমন হয়, তেমনি হয় দেশের কল্যাণ। কায়িক ও মানসিক উভয় প্রকার শ্রমের মাধ্যমেই ব্যক্তি এবং জাতি মাথা উঁচু করে চলতে পারে। জাতীয় উন্নয়নে শ্রমের গুরুত্ব অনেক। শ্রমবিমুখ জাতির পতন অনিবার্য। জগতের মহামনীষীরা সকলেই পরিশ্রম করেছেন এবং শ্রমের মর্যাদা দিয়ে গেছেন । জগতের এত যে কীর্তি স্থাপিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে মানুষের চিন্তা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। শ্রমকে ঘৃণার চোখে বিচার করলে দেশে উৎপাদনের জোয়ার আনা যায় না, জাতীয় সমৃদ্ধির স্বপ্ন রচনা করা যায় না। শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেই পরিশ্রমের প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব। তাই সকল প্রকার শ্রমেরই মর্যাদা নিশ্চিত হওয়া প্রয়ােজন। তাহলে যারা শ্রম দেয় তারা আর শ্রমবিমুখ থাকবে না এবং দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
উপসংহার :
জীবনের সর্বক্ষেত্রে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের পরিশ্রমকে কোনাে সমাজ কোনাে কালেই তার যােগ্য মর্যাদা দেয় নি। যারা। সত্যিকার অর্থেই জীবনে সম্মান পেয়েছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, পরিশ্রমেই জীবনের প্রকৃত আনন্দ। পরিশ্রমই জীবনের অশেষ দুঃখ-কষ্ট হতে মানুষকে মুক্তির সন্ধান দেয়। তাই সকল প্রকার শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়ােজন।
Postar um comentário